লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর Class 11 Bengali Second Semester

এখানে লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর Class 11 Bengali Second Semester শেয়ার করা হলো।

লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর
Class 11 Bengali Second Semester
ছোটো প্রশ্ন ও উত্তর

১) “এই মানুষে মানুষ গাথা / দেখনা যেমন আলেক লতা” – উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও।

উত্তর: এই উদ্ধৃতিটি খ্যাতনামা বাউল সাধক লালন শাহ্ ফকিরের ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ থেকে গৃহীত।

বাউল সাধক লালন ফকির আলোচ্য কবিতায় ঈশ্বরের সত্যিকার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে চেয়েছেন। বাউলতত্ব অনুযায়ী, ঈশ্বরের অবস্থান আমাদের দেহ তথা হৃদয়ের মধ্যে রয়েছে। সাধারণত, ঈশ্বরকে আমরা বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে থাকা, অলৌকিক শক্তি হিসেবে মনে করি, কিন্তু আসলে তিনি আমাদের দেহের মধ্যেই বাস করেন। উদ্ধৃতিতে “মানুষ” বলতে সাধারণ মানুষ ও “মনের মানুষ” অর্থাৎ ঈশ্বরকে বোঝানো হয়েছে। “আলেক” (অলক্ষ বা অলৌকিক) অর্থে ঈশ্বরকে নির্দিষ্ট আকারে না দেখালেও তিনি লতার মতো মানুষকে প্রতিনিয়ত জড়িয়ে থাকেন। এভাবেই উদ্ধৃতিটি ঈশ্বরের অন্তর্নিহিত উপস্থিতি এবং তাঁর মানবিক সম্পর্কের কথা ব্যক্ত করছে।

২) “… মানুষ – আকার/ ভজলে তরবি ।।”- পঙ্ক্তিটির অর্থ বুঝিয়ে দাও।

উত্তর: এই পঙ্ক্তিটির অর্থ: লালন শাহ্ ফকিরের সাধনা কোনো নির্জন অরণ্যচারী সন্ন্যাসীর সাধনা নয়, বরং এটি মানুষের মধ্যেই সাধনা করার কথা। লালন ফকির তাঁর সাধনায় বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর মানুষের মধ্যে অবস্থান করেন, এবং ঈশ্বরকে জানার জন্য সাধককে মানুষকেই ভজনা করতে হবে। এখানে “মানুষ – আকার” বলতে মানুষের দেহকে ঈশ্বরের সাকার রূপ হিসেবে দেখা হয়েছে।
তাই সাধক লালন তাঁর ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতায় পাঠক বা শ্রোতাদের জানান যে, ঈশ্বর যদি নিরাকার হন, তবে তিনি মানুষের আকারেই সাকার হয়ে থাকেন, এবং এই আকারে সাধনা করলেই ঈশ্বর লাভ সম্ভব। মানুষের বাদে সাধনা অসম্পূর্ণ এবং অর্থহীন হয়ে যাবে। মানুষের দেহেই ঈশ্বরের ভজন বা সাধনা সার্থক।

৩) “দেখনা যেমন আলেক লতা”- ‘আলেক লতা’ কী? বাউলতত্ব অনুসারে তার বৈশিষ্ট্য কী?

উত্তর: ‘আলেক লতা’: সাধক কবি লালন শাহ্ রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতায় ‘আলেক’ শব্দটির অর্থ হলো অলৌকিক বা অলক্ষ, আর ‘লতা’ দ্বারা বোঝানো হয়েছে কোনো লতানো গাছ। তবে এখানে ‘আলেক লতা’ বলতে বোঝানো হয়েছে সেই অলৌকিক শক্তি, যা লতানো গাছের মতোই মানুষের জীবনকে অদৃশ্যভাবে জড়িয়ে রাখে, এবং সেই পরম পুরুষ বা ঈশ্বরকে।

বৈশিষ্ট্য:

বাউলতত্ব অনুযায়ী, ঈশ্বর অলক্ষ, অলৌকিক, এবং অদৃশ্য থাকলেও তিনি মানুষের দেহের মধ্যে অবস্থান করেন, ঠিক যেমন একটি লতা গাছের মতো মানুষকে জড়িয়ে থাকে। বাউলরা মনে করেন, দেহের সুখই মনের সুখ, এবং মনের সুখ মানে ঈশ্বরের সুখ। ঈশ্বরের উপস্থিতি মানুষের অন্তরেই, এবং এই ধারণা বাউলতত্বের বৈশিষ্ট্য।

লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর
Class 11 Bengali Second Semester
ছোটো প্রশ্ন ও উত্তর

৪) “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” – সোনার মানুষ হওয়ার যে পদ্ধতি আলোচ্য কবিতায় বলা হয়েছে, তা লেখো।

উত্তর: সোনার মানুষ হওয়ার যে পদ্ধতি বাউল সাধকরা বিশ্বাস করেন, তা হল—মানুষের মধ্যে পরম মানুষ অর্থাৎ, ঈশ্বরের অবস্থান রয়েছে। ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার জন্য মানুষকেই ভজন বা সাধনা করতে হবে। এখানে “সোনার মানুষ হওয়া” বলতে বোঝানো হচ্ছে, ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পরম সত্যের সন্ধান পাওয়া।
বাউলদের মতে, দেহ ছাড়া ঈশ্বরের সাধনা সম্ভব নয়, কারণ সাধনার জন্য দেহই একমাত্র উপকরণ। ঈশ্বরকে ভজনা করতে হলে দেহ এবং মনের মধ্যে কোনো তফাত রাখা যাবে না। লালন শাহ্ ফকিরের গানে কবি এই ধারণা ব্যক্ত করেছেন যে, সাধনার মাধ্যমে মানুষের অন্তরে ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করে সোনার মানুষ হওয়া সম্ভব।

৫) “জেনে শুনে মুড়াও মাখা/ জাতে তরবি।।”- কাকে উদ্দেশ করে এই উক্তি? উক্তিটির তাৎপর্য কী?

উত্তর:
উদ্দেশ্য:

এই উক্তিটি কবি লালন শাহ্ ফকির তাঁর ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতায় ভবিষ্যৎ বাউল সাধকদের উদ্দেশে করেছেন।

তাৎপর্য:

সাধকরা সাধারণ সমাজ থেকে উঠে আসা মানুষ। তাদের মধ্যে পার্থিব কামনা-বাসনা এবং জাত-পাতের বিচারও রয়েছে। তবে সাধনা করতে করতে তারা এসব পার্থিব সংক্রান্ত সকল সংস্কার ও বাঁধনকে উপেক্ষা করতে সক্ষম হন। লালন শাহ্ ফকির এখানে বলতে চেয়েছেন, যে সাধক দেহসাধনা করে, অর্থাৎ ঈশ্বরের সাধনা করতে করতে, পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলিত হতে পারে। কিন্তু, সঠিকভাবে সাধনা না করলে সেই সাধনা পূর্ণ হবে না। তাই “জেনে শুনে মুড়াও মাখা/ জাতে তরবি” বলতে কবি বোঝাতে চেয়েছেন, সাধক যখন সত্যিকার অর্থে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হতে চাইবেন, তখন তাঁর সমস্ত বদ্ধমূল ধারণা, সংস্কার এবং জাতপাতের বাঁধনকে অতিক্রম করতে হবে।

৬) ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতায় বাউল সাধনার দেহতত্ব কীভাবে ব্যাখিত হয়েছে, আলোচনা করো।

উত্তর: বাউল সাধনা দেহতত্ব:

বাউল সাধনা মূলত দেহতত্বের সাধনা। বাউলদের মতে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব দেহের মধ্যে বিরাজমান এবং ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে হলে দেহের মাধ্যমে সাধনা করতে হয়। বাউল সাধনা একে অপরকে পরিপূর্ণ করতে চায়, এবং এই সাধনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেহের মাধ্যমে আত্মার মুক্তি অর্জন। বাউল সাধনায় সাধক বা সাধিকাকে শরীরের ভেতরের শক্তি বা “শুক্র” (যাকে বাউলরা “দেহের শুক্র” বা জীবনশক্তি বলেন) থেকে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়।

বাউল ধর্মে বলা হয় যে, দেহই সাধনার মূল উপকরণ এবং ঐ দেহের মধ্যে ঈশ্বর বিরাজিত। “দেহতত্ব” এর মাধ্যমে তারা এই দেহকে ঈশ্বরের উপাসনার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শেখে। এই দেহই তাদের সাধনার মাধ্যমে পরম সুখ বা পরম আনন্দের স্তরে পৌঁছায়। এভাবেই তারা অলক্ষ বা অলৌকিক ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করে। ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতায় লালন শাহ্ এই দেহতত্বের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, যেখানে দেহ এবং মন এক হয়ে ঈশ্বরের সাধনা করতে হবে।

সাধকের সাধনা এবং সংযমের মাধ্যমে সুষুম্না নাড়ি (যেখানে জীবনের শক্তি প্রবাহিত হয়) খোলার চেষ্টা করা হয়, এবং এই খোলার মধ্য দিয়ে তারা অলক্ষ ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করেন। তারা বিশ্বাস করেন, দেহের মাধ্যমেই ঈশ্বরের মিলন সম্ভব এবং এর মাধ্যমে একটি গভীর আনন্দ বা পরম সুখ লাভ করা যায়।

লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর
Class 11 Bengali Second Semester
ছোটো প্রশ্ন ও উত্তর

৭) “মানুষ-গুরু কৃপা হ’লে / জানতে পাবি ।।” – ‘মানুষ-গুরু’ কে? তাঁর কৃপা কীভাবে জানা যায়?

উত্তর:

‘মানুষ-গুরু’:

কবি-সাধক লালন শাহ্ রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতায় ‘মানুষ-গুরু’ বলতে এমন একজন পরম সাধক বা গুরুকে বোঝানো হয়েছে, যিনি দেহের বাইরে থাকা পরম ঈশ্বরের প্রতিনিধি। এই গুরু সাধকই প্রকৃত ঈশ্বরের পরিচায়ক। সাধকের মধ্যে ঈশ্বরের উপস্থিতি থাকে, তবে তিনি চোখে দেখা যায় না। ‘মানুষ-গুরু’ হল সেই সাধক, যিনি ঈশ্বরের রূপে পূর্ণ, এবং তাঁর কৃপা লাভের মাধ্যমে সাধক আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেন।

কৃপা জানার উপায়:

তাঁর কৃপা জানার জন্য, সাধককে তাঁর সাধনার মধ্যে গভীর প্রতিশ্রুতি ও নিষ্ঠা অনুসরণ করতে হয়। সাধক যতক্ষণ না তার সাধনায় সিদ্ধি অর্জন করেন, ততক্ষণ তিনি মন থেকে অতৃপ্তি এবং অন্ধকারে আবৃত থাকেন। তবে যখন সেই ‘মানুষ-গুরু’ তার সাধনায় সিদ্ধ হয়ে পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করেন, তখন তিনি কৃপা প্রদর্শন করেন। সাধক দেহতত্ব অনুসরণ করে এবং নিজেকে পরিশুদ্ধ করে সেই কৃপা অনুভব করেন। এই কৃপা লাভের পর, সাধক ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন, এবং তখন তিনি ‘মানুষ-গুরু’-এর কৃপা ও প্রজ্ঞা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।

৮) “মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।” – এখানে কোন্ মানুষের কথা বলা হয়েছে? ক্ষ্যাপা কে? সে কীভাবে মূল হারিয়ে ফেলে?

উত্তর: কবি লালন শাহ্ রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতা থেকে গৃহীত আলোচ্য উদ্ধৃতিতে ‘মানুষ’ বলতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের কথা বলা হয়েছে।

ক্ষ্যাপার পরিচয়:

বাউল সাধকরা নিজেদেরকে ‘ক্ষ্যাপা’ বলেই পরিচয় দেন। কারণ, তাঁরা মনের ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য সদা উন্মত্ত, উন্মুখ।

মূল হারিয়ে ফেলা:

‘মূল’ বলতে এখানে পরম ঈশ্বরের সাধনাকে বোঝানো হয়েছে। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই এই সাধনার পথ। মানুষের থেকে দূরে সরে যাওয়ার মানে হলো পথভ্রষ্ট হওয়া।

৯) “দ্বি-দলের মৃণালে / সোনার মানুষ উজ্জ্বলের” – কথাটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: কবি লালন শাহ্ রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতা থেকে গৃহীত আলোচ্য উদ্ধৃতিতে ‘দ্বি-দল’ বলতে দুটি পদ্মের পাপড়ির কথা বলা হয়েছে, এখানে মানুষের দুটি চোখ। বাউল সাধনার দেহতত্বের ব্যাখ্যা অনুযায়ী দুটি ভ্রু এবং নাকের গোড়ায় অবস্থিত জায়গাটির নাম দ্বি-দল।

বাউল সাধকরা দেহসাধনার মধ্য দিয়ে যে পরম পরিতৃপ্তি লাভ করেন, তা মূলত সুষুম্নানাড়ির মধ্য দিয়ে এক বিশিষ্ট অনুভূতির সঞ্চালন। তাঁরা ভাবেন, এর মধ্যে দিয়ে ‘পরম মানুষ’ পরিতৃপ্ত হন।

লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর
Class 11 Bengali Second Semester
বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর

১) ‘লালন শাহ কে ছিলেন? পাঠ্য লালন গীতিকা অবলম্বনে মূল বিষয়টি ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: লালন ফকির ছিলেন বাউল সাধনার প্রধান গুরু। তিনি অসংখ্য বাউল গান রচনা করেছেন। ১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭৭২) তাঁর জন্ম। তবে তাঁর জন্মসাল, জন্মভিটা, জাতিসূত্র এবং গানের সংখ্যা নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে।

লালনকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। তাঁকে ঘিরে বহু জনশ্রুতি, অসংখ্য সত্য-মিথ্যা গল্প প্রচলিত। শোনা যায়, তীর্থভ্রমণের পথে দুরারোগ্য বসন্তে আক্রান্ত হয়ে তিনি সঙ্গীদের দ্বারা পরিত্যক্ত হন। তখন সিরাজ সাঁই তাঁকে নিজের গৃহে এনে সেবা-শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তোলেন।

ব্যাখ্যা:

লালনের গানে মানব মহিমা অনবদ্য ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন:
“এই আছে রে মন, যারে বলে মানুষ রতন
লালন বলে, পেয়ে সে ধন পারলাম না রে চিনিতে।।”

লালন সহজ সাধনার পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি কোনো ধরনের সামাজিক বা ধর্মীয় সংস্কারকে গুরুত্ব দেননি। তাঁর মতে, মানুষ ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই। তিনি মানুষের মধ্যেই অরূপ রতন সন্ধান করেছেন। লালন মরমি ধারার সাধক ছিলেন, যিনি মনের মনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন।

লালনের দর্শনে বলা হয়েছে, ঈশ্বর বা আল্লাহ যদি থাকেন, তবে তিনি মানুষের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হন। তিনি বলেছেন:
“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
নইলে পরে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।”

লালনের গানে তত্ত্বের কথা ধরা দিয়েছে। তাঁর দর্শনে ‘সোনার মানুষ’-এর সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি ‘মানুষ-গুরু’কে স্বীকার করেছেন এবং অনুভব করেছেন যে, ‘মানুষ-গুরু’র কৃপা ছাড়া ঈশ্বরের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা যায় না। তাই লালন গেয়েছেন:
“মানুষ ছাড়া মন আমার পড়বি রে তুই শূন্যকার।”

‘লালন শাহ ফকিরের গান’ মূলত মানব বন্দনার গান। এখানে লালনের সহজ সাধনা এবং মানবতত্ত্বই প্রকাশ পেয়েছে।

২) লালন শাহ ফকিরের গানে কীভাবে মানব বন্দনা হয়েছে তা লেখো।

উত্তর: লালন শাহ্ জাতিভেদ, ধর্মীয় সংস্কার, আচার-বিচার, এবং কুসংস্কারে বিশ্বাস রাখতেন না। তিনি সংস্কারমুক্ত এবং সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি থেকে মুক্ত এক মানবতাবাদী সাধক ছিলেন। তাঁর কাছে মানুষই ছিল পরম সত্য। লালন বলেছেন:
“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।”

উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, মানুষের দেহ ও মন বাউল সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। বাউলদের কাছে মানুষই পরম সম্পদ। তাঁরা মানুষকে ‘মানুষ রতন’ নামে চিহ্নিত করেন এবং বিশ্বাস করেন মানুষের মধ্যেই ‘মনের মানুষ’ তথা ঈশ্বর অবস্থান করেন। বাইরের কোনো উপচার বা আরাধনার মাধ্যমে তাঁকে পাওয়া সম্ভব নয়।

লালন তাঁর গানে বলেছেন:
“মানুষের মধ্যে রয়েছে সেই পরম সত্তা।”

এই সত্য বোঝাতে তিনি আরও বলেছেন:
“মানুষে মানুষ আছে, যাবে জানা।”

লালনের মতে, পরম মানুষকে অনুভব করতে হলে প্রথমে নিজের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে হয়। বাইরের কোনো আরাধনায় তাঁকে পাওয়া যায় না। মানুষরূপী গুরুর কৃপা ছাড়া পরম সত্তার উপলব্ধি অসম্ভব।

“মানুষ ছাড়া মন আমার পড়বি রে তুই শূন্যকার।”

লালনের গানে মানুষের জয়ধ্বনি করা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বাস করেন এবং মানুষকে বাদ দিয়ে ঈশ্বরের সন্ধান করা অর্থহীন। বাউল ধর্ম কোনো আরোপিত ধর্ম নয়; এটি সহজ সাধনার পথ। লালন বলেছেন:
“আপন ভজন-কথা না কহিবে যথা-তথা।”

পরম সত্তাকে অনুভব করতে হলে গোপনীয়তা রক্ষা এবং সহজ সাধনার প্রয়োজন। লালনের গানে এই সহজ সাধনার পথ অন্বেষণ করা হয়েছে। মানবতাবাদই তাঁর দর্শনের মূল কথা। সুতরাং, লালন শাহ ফকিরের গান আসলে মানব বন্দনার সুরেই রচিত।

লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর
Class 11 Bengali Second Semester
বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর

৩) “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”- মানুষকে ভজনা করলে কীভাবে ‘সোনার মানুষ’ হওয়া যায়?

উত্তর: বাউল সাধক লালন প্রথাগত ধর্ম বা আচার-বিচারে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি লোকায়ত সাধনার মাধ্যমে মানুষের অন্তরে ঈশ্বরের সন্ধান করেছেন। তাঁর মতে, ঈশ্বরকে পেতে হলে মনের মানুষকে খুঁজতে হবে এবং মানুষের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে।

লালন বলেছেন:
“মনের মানুষ মনের মাঝে করো অন্বেষণ।”

মানুষকে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা করা ছাড়া ঈশ্বরকে পাওয়া সম্ভব নয়। লালন বিশ্বাস করতেন, মন্দির-মসজিদে পরম শক্তিকে পাওয়া যায় না। বরং মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের বসবাস। তাই মানুষকে ভজনা করার মাধ্যমেই ‘সোনার মানুষ’ বা পরম সত্তাকে উপলব্ধি করা সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, মানুষরূপী গুরুর কৃপা ছাড়া ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়া যায় না। এই ‘গুরু’ হলেন মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান এক বিশেষ সত্তা, যাঁর কৃপায় মানুষ সত্যিকারের জ্ঞানে উন্নীত হয়। লালনের মতে, মানুষকেই ভক্তি করলে, তাঁর মধ্যেই ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি দেখা সম্ভব।

বাউল সাধনা আসলে মানবপ্রেমের সাধনা। এই সাধনা তন্ত্র বা বেদনির্ভর নয়, বরং সহজ ও মানবিক। লালন বিশ্বাস করতেন, মানুষই ঈশ্বরের প্রকৃত রূপ, তাই মানুষকে বাদ দিয়ে কোনো সাধনা বা ঈশ্বরের সন্ধান বাস্তবায়িত হতে পারে না।

সুতরাং, মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই একজন সাধক ‘সোনার মানুষ’ বা পরম মানবীয় সত্তার পূর্ণতা অর্জন করতে পারে।

৪) মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।” – ‘ক্ষ্যাপার’ প্রতি এই সাবধানবাণী কেন?

উত্তর: লালন শাহ্ তাঁর সাধনায় মানবপ্রেমকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, মানুষকে বাদ দিয়ে ধর্মচর্চা বা সাধনা কোনো অর্থ বহন করে না। এই বক্তব্যে ‘ক্ষ্যাপা’ বলতে বোঝানো হয়েছে সেই ব্যক্তি বা সাধককে, যিনি মানুষকে বাদ দিয়ে ঈশ্বর বা পরম শক্তির সন্ধান করতে চান। লালন এ ধরনের আচরণের বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছেন।

লালন বিশ্বাস করতেন, মানুষই ঈশ্বরের প্রকৃত আধার। তিনি বাইরের মন্দির, মসজিদ, বা পুথিপাঠের মধ্যে ঈশ্বরের সন্ধান করার চেয়ে মানবমনের গভীরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব খুঁজতে বলেছেন। তাঁর মতে, মানুষ ছাড়া ধর্ম, সাধনা বা ঈশ্বরচিন্তা অসম্পূর্ণ। এই কারণেই তিনি বলেছেন:
“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”

লালন অলৌকিকতা, ভণ্ডামি, এবং জাতিভেদের বিপক্ষে ছিলেন। তাঁর মতে, যদি মানুষকে উপেক্ষা করা হয়, তবে ঈশ্বরের সন্ধান মিথ্যা হয়ে যায়। তিনি মনে করতেন, মানুষ-গুরু বা ‘মনের মানুষ’-এর প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে সমস্ত সাধনা শূন্য হয়ে পড়ে। তাই ‘ক্ষ্যাপা’ যদি মানুষকে ছেড়ে অন্য কোথাও পরম সত্তার খোঁজ করেন, তবে তাঁর মূল লক্ষ্য হারিয়ে যাবে।

লালনের এই চিন্তাধারা চৈতন্যদেবের মানবপ্রেমের ভাবনার সঙ্গে মিলিত। মধ্যযুগে চৈতন্যদেব ঘোষণা করেছিলেন, মানুষের মধ্যে ঈশ্বর বিরাজমান। একইভাবে, লালনও বলেছেন, মানুষের মধ্যেই ‘সোনার মানুষ’ বা ‘পরম মানুষ’-এর অস্তিত্ব রয়েছে।

সুতরাং, লালনের এই সাবধানবাণী ‘ক্ষ্যাপা’কে সঠিক পথে রাখার একটি দিকনির্দেশনা, যাতে সে তার সাধনার মূল লক্ষ্য হারিয়ে না ফেলে।

লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর
Class 11 Bengali Second Semester
বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর

৫) “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” এবং “দ্বি-দলের মৃণালে সোনার মানুষ উজ্জ্বলে” এই দুই পঙক্তিতে ‘সোনার মানুষ’ শব্দটি কোন কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে?

উত্তর:

প্রথম অর্থে:

লালন শাহ্ রচিত “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” পঙক্তিতে ‘সোনার মানুষ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে মনুষ্যত্বে উন্নীত এক খাঁটি মানুষের অর্থে। লালন এখানে বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষের মধ্যে যে মানবধর্ম এবং মানবতার সত্য বিদ্যমান, সেটি অন্বেষণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ একদিন খাঁটি মানুষ বা ‘সোনার মানুষ’-এ পরিণত হতে পারে।

মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বাস—এই ধারণার উপর ভিত্তি করে বাউল দর্শনে বলা হয়েছে, মানুষের সঙ্গে মানুষের সেবা ও ভালোবাসার সম্পর্কই ঈশ্বরের নিকট পৌঁছানোর একমাত্র পথ। কঠোর সাধনা, আত্মোপলব্ধি ও মানবপ্রেমের মাধ্যমে একজন সাধারণ ব্যক্তি নিজেকে ‘সোনার মানুষ’-এ উন্নীত করতে পারে, যেমন পরশমণির স্পর্শে লোহা সোনায় পরিণত হয়। এই খাঁটি মানুষই মানবতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে ‘মানুষ রতন’ হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় অর্থে:

“দ্বি-দলের মৃণালে সোনার মানুষ উজ্জ্বলে” পঙক্তিতে ‘সোনার মানুষ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে মনের মানুষ, অন্তরাত্মা বা পরমপুরুষ অর্থে। এখানে ‘সোনার মানুষ’ হলেন সেই চিরন্তন সত্তা, যিনি মানবদেহের অন্তরে অবস্থান করেন।

বাউল দর্শনে ঈশ্বর বা ‘পরমপুরুষ’কে বাইরের মন্দির, মসজিদ, বা কোনো বাহ্যিক উপাসনালয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি মানুষের শরীরের ছয় চক্রের আজ্ঞা চক্রে অবস্থান করেন। সাধনা ও আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে তাঁকে উপলব্ধি করা সম্ভব। এখানে ‘সোনার মানুষ’ ঈশ্বরতুল্য এক পরমাত্মার প্রতীক, যিনি জীবাত্মার মাধ্যমে প্রকাশিত হন।

৬) “দেখ না যেমন আলেক লতা” – ‘আলেক লতা’ শব্দটির অর্থ এবং কবি তাঁর সান্নিধ্য কেন চেয়েছেন?

উত্তর:
আলেক লতার অর্থ:

“আলেক লতা” শব্দটি একটি বিশেষ আধ্যাত্মিক প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আলেক লতা বাস্তবে একটি পরজীবী উদ্ভিদ, যা অন্য গাছের গায়ে জড়িয়ে থাকে এবং তার থেকে খাদ্য গ্রহণ করে বাঁচে। তবে লালন শাহ্ এখানে এই শব্দটির গভীর আধ্যাত্মিক অর্থ দিয়েছেন। ‘আলেক’ শব্দটি অলক্ষ্য বা অদৃশ্য পরমাত্মাকে নির্দেশ করে, যে পরমাত্মা মানবদেহের মধ্যে বিরাজমান। ‘লতা’ এখানে পরমাত্মার সঙ্গে মানুষের আত্মার সম্পর্ককে বোঝায়, যেমন এক পরজীবী উদ্ভিদ তার জীবনের জন্য অন্য গাছের ওপর নির্ভরশীল থাকে, তেমনি পরমাত্মাও মানুষের আত্মায় বিরাজমান। বাউল ধর্মে পরমাত্মাকে ‘আলেক সাঁই’ বা ‘অলখ-নিরঞ্জন’ বলা হয়, যা মানে ঈশ্বর বা সৃষ্টির উৎস, যে কোন ভৌত রূপ ধারণ করে না।

কবি কেন সান্নিধ্য চেয়েছেন:

লালন শাহ্ তাঁর গানে পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পরমাত্মার অস্তিত্ব মানবদেহের মধ্যে বিরাজমান, এবং তাকে উপলব্ধি করতে হলে, সাধনা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন। আলেক লতা বা অলখ-নিরঞ্জন, যেমন একটি উদ্ভিদ অন্য গাছের মধ্যে আটকে থাকে, তেমনি পরমাত্মাও মানুষের অন্তরে মিশে থাকে। তাই, লালন সাঁই পরমাত্মার সান্নিধ্য চেয়েছেন, যাতে তাঁর জীবনের পূর্ণতা আসে। তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি একজন ব্যক্তি পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভ করতে পারে, তবে সে মানবধর্মের পূর্ণতা লাভ করবে এবং পরমাত্মার মিলনে মুক্তি পাবে। তাই তাঁর জন্য আলেক লতার সান্নিধ্য ছিল পরমাত্মার সাথে একত্ববোধ ও আত্মার মুক্তির পথ।

৭) “লালন শাহ ফকিরের গান” গীতি কবিতাটির মধ্যে রচয়িতার যে মনোভাব ফুটে উঠেছে, তা নিজের ভাষায় লেখো।

মানবতত্ত্বের স্বরূপ:

লালন শাহের রচনায় মানবতত্ত্বের গভীর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানবদেহই ঈশ্বরসাধনার কেন্দ্র। দেহতত্ত্বের মাধ্যমে পরমাত্মার সন্ধান করা যায়। তাঁর মতে, জাগতিক কামনা-বাসনা ত্যাগ করে সহজিয়া বাউল সাধনার পথ ধরে মুক্তি লাভ করা সম্ভব। কিন্তু এই মুক্তি অর্জনের জন্য মানুষকেই অনুসন্ধান করতে হবে, কারণ মানবদেহের বাইরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অন্বেষণ করা অর্থহীন।

মানবসত্তার স্বরূপ:

লালন শাহ মানবসত্তার বিশ্লেষণে বলেছেন, ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম—এই পঞ্চভূত যেমন জগৎ সৃষ্টির উপাদান, তেমনই মানবদেহেও এই উপাদান বিদ্যমান। ঈশ্বর, যিনি সর্বত্র বিরাজমান, তিনিও এই পঞ্চভূতের মাধ্যমে মানবদেহে বাস করেন। লালন সাঁই এই ধারণাকে তাঁর গানে ফুটিয়ে তুলেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন—“এই মানুষে মানুষ গাথা।” অর্থাৎ মানুষ ও মানুষের অন্তরাত্মার মধ্যে গভীর সংযোগ রয়েছে, যা ঈশ্বরসাধনার পথ দেখায়।

মানবতার সুর:

“লালন শাহ ফকিরের গান”-এর মূল সুর মানবতাবাদ। লালন জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকেই সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হতে হলে মনুষ্যত্বের সাধনা করতে হবে। মানুষ-গুরুর কৃপায় অন্তরের অজ্ঞতার অন্ধকার দূর হয়ে জ্ঞানের আলো ফুটে ওঠে। এই জ্ঞানই মানুষকে খাঁটি মানুষ, সোনার মানুষে রূপান্তরিত করে।

লালনের মনোভাব:

লালনের গান থেকে স্পষ্ট হয়, তিনি বিশ্বাস করতেন “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্তাধারায় তিনি মানবতাকেই ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর রচনায় যে মানবতাবাদী সুর ধ্বনিত হয়েছে, তা শুধুমাত্র ধর্মীয় নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। লালন এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ ভুলে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিতে হবে।

আরও দেখো: তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment

CLOSE

You cannot copy content of this page