বিজ্ঞান সাধনায় বাঙালি প্রবন্ধ রচনা // ৪৫০ ও ৬০০ শব্দের মধ্যে

এই পর্বে বিজ্ঞান সাধনায় বাঙালি সম্পর্কে ৪৫০, ৬০০ শব্দের মধ্যে প্রবন্ধ রচনা লিখে দেওয়া হলো।

বিজ্ঞান সাধনায় বাঙালি প্রবন্ধ রচনা (৪৫০ শব্দের মধ্যে)

মানুষের পটভূমি হয়তো শ্বাশ্বত যাত্রীর — জীবনানন্দ দাশ

ভূমিকা:

বিজ্ঞানের যে বিপুল অগ্রগতি একুশ শতকের মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে সেখানে বাঙালির অবদান উপেক্ষণীয় নয়। যে বাংলা রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বজয়ী প্রতিভার জন্ম দিয়েছে কিংবা অমর্ত্য সেনের মতো অর্থনীতিবিদ বা সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের মতো চলচ্চিত্রকার তৈরি করেছে সেই বাংলা বিজ্ঞান সাধনাতেও আদায় করে নিয়েছে গোটা পৃথিবীর সম্ভ্রম।

ইতিহাসের পথ ধরে:

চৈনিক পরিব্রাজক উয়াং চুয়াং এর বিবরণে প্রাচীন বৌদ্ধবিহার গুলিতে বিজ্ঞান চর্চার বর্ণনা পাওয়া যায়। চক্রপানি দত্তের চরক ও সুশ্রুতের ওপর লেখা বই আয়ুর্বেদ দীপিকা এবং ভানুমতি, শুরপালের বৃক্ষায়ুর্বেদ এবং লৌহপদ্ধতি বাঙালির প্রাচীন বিজ্ঞান সাধনার নিদর্শন। নৌবিজ্ঞান এবং তন্ত্রসাধনার হাত ধরে বাঙালির শারীরবিদ্যাচর্চাও বিস্তার লাভ করেছিল প্রাচীন যুগে।

উনিশ শতকে বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা:

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার উনিশ শতকে বাঙালির মনন চর্চা এবং বিজ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রকে খুলে দেয়। ১৭৮৪ তে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা বাঙালির বিজ্ঞান চর্চাকে অনুপ্রাণিত করে। কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা এই ধারায় আর একটি মাত্রা নিয়ে আসে। আর ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স বাঙালির বিজ্ঞান সাধনাকে প্রথম সংহত রূপ দেয়।

আধুনিককালে বাঙালির বিজ্ঞান চর্চা:

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বিনা তারে বিদ্যুৎতরঙ্গ প্রেরণ করে বেতারবার্তা আবিষ্কার করেন। ক্রেসোকোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে জগদীশ চন্দ্র বসু উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও অনুভূতি ক্ষমতাকে প্রমাণ করেন। ১৯১৭ তে বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করে জগদীশচন্দ্র বাঙ্গালীর বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেন।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মারকিউরাস নাইট্রেট নামক যৌগ আবিষ্কার করেন। তার হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস এদেশের বিজ্ঞান সাধনার এক তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ‘ বেঙ্গল কেমিক্যালস এন্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ‘ এর প্রতিষ্ঠাতা। প্রফুল্লচন্দ্রের বিশিষ্ট ছাত্র মগন মুখোপাধ্যায় কলয়েড রসায়নের আবিষ্কার করেন। এছাড়া নীলরতন ধর, প্রিয়দারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রসিকলাল দত্ত, পুলিনবিহারী সরকার প্রমূখ প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্রবৃন্দ বিজ্ঞান সাধনায় বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আবিষ্কার ‘ বোস সংখ্যায়ন তত্ত্ব ‘ আলোড়ন ফেলেছিল পৃথিবী জুড়ে, মেঘনাদ সাহার তাপীয় সমীকরণ সূত্র পরমাণু গবেষণায় নতুন মাত্রা আনে। তার প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স পরমাণু বিষয়ক গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

পরিসংখ্যানবিদ্যায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এক স্মরণীয় নাম। তার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট পরিসংখ্যানবিদ্যা চর্চার পিঠস্থান। অংক শাস্ত্রে রাধানাথ শিকদার, পদার্থবিদ্যায় শিশির কুমার মিত্র, নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানে নির্মল কুমার বসু এবং রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের নামও বাঙালির বিজ্ঞান সাধনায় উল্লেখযোগ্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছিলেন। ড. সহায়রাম বসু, ড. মহেন্দ্রলাল সরকার, ড. রাধাগোবিন্দ কর প্রমুখের নামও চিকিৎসা বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য।

সাম্প্রতিককালে ড. মনি ভৌমিক, অসীমা চট্টোপাধ্যায়, জীববিজ্ঞানে ড. আনন্দমোহন চক্রবর্তী কিংবা চিকিৎসা বিজ্ঞানে ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নাম বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। বসু বিজ্ঞান মন্দির, সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, ইন্ডিয়ান কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স ইত্যাদি গবেষণাক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে বাঙালি আজও নিরলস বিজ্ঞান সাধনায়।

উপসংহার:

উন্নত পরিকাঠামো এবং উপযুক্ত সুযোগ বাঙালি গবেষকের জন্য বেশি দরকার। গোটা ভারতের মতো এ রাজ্যের কৃতি ছাত্ররাও উন্নত গবেষণার জন্য বিদেশে পাড়ি দেন। বাঙালির গর্ব আর অহংকার এভাবেই অধিকৃত হয়ে যায়। মেধার পরিচর্যা তাই আমাদের সকলেরই আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। তাহলেই সম্ভব হবে বাঙালির বিজ্ঞান সাধনার ঐতিহ্যকে ধরে রাখা।

বিজ্ঞান সাধনায় বাঙালি প্রবন্ধ রচনা (৬০০ শব্দের মধ্যে)
ভূমিকা:

বিজ্ঞান শব্দের অর্থ বিশেষ জ্ঞান। এই বিশেষ জ্ঞানের চর্চা আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ধন্বন্তরি থেকে এ যুগের আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য, মেঘনাথ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ বিজ্ঞানী দের জ্ঞানে-মনীষায় নতুন সমাজের প্রস্তাবনা আমাদের অঙ্গীকার। আর সেই অঙ্গীকারের দৃপ্তকন্ঠ বাঙালি। বাঙালি চিরকালই শক্তি অপেক্ষা বুদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়েছে। আর সেই বুদ্ধি চর্চার উন্নত প্রসারণ ক্রমশ এগিয়ে চলেছে সে। এভাবেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও গোটা পৃথিবীতে আলাদা মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠেছে বাঙালি।

বাঙালির শিক্ষা চেতনা:

সাধারণভাবে সমগ্র পৃথিবী জুড়েই অলস, খাদ্যরসিক এবং অর্থবিমুখ বলে বাঙালির বদনাম আছে। কিন্তু এই অলস বাঙালি নিজের জীবনে যে জিনিসটিকে বরাবর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে তা হল শিক্ষা ও শিক্ষা থেকে উদ্ভূত চেতনা। বিজ্ঞান সাধনার প্রাথমিক পূর্ব শর্তই হল সুশিক্ষার দ্বারা আলোকিত সচেতন মন। সে কারণেই হয়তো বৈষয়িক সম্পদের মূল্য বাঙালির কাছে গৌণ বরং শিক্ষার আত্মিক সম্পদের মুখ্য। এই সামগ্রিক শিক্ষা চেতনায় বাঙালির মনকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলেছে।

বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা:

বাঙালির বিজ্ঞান সাধনায় দুটি ধারা পরিলক্ষিত হয়।

প্রথমত বিজ্ঞান বিষয়ক বিবিধ রচনা। রচয়িতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, জগদানন্দ রায় প্রমুখ।

দ্বিতীয়তঃ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে মৌলিক গবেষণা: বিভিন্ন বিভাগে খ্যাতনামা বাঙালি বিজ্ঞানীরা ছিলেন-

জগদীশচন্দ্র বসু:

বাঙালি বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। তিনিই প্রথম বেতার তরঙ্গ উৎপাদনের যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করেন ও প্রমাণ করেন যে উদ্ভিদের ও প্রাণ আছে। তার রচনা অব্যক্ত বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। পরাধীন ভারতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বার্থে তিনি 1997 সালে প্রতিষ্ঠা করেন বসু বিজ্ঞান মন্দির।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়:

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এদেশে নব্য রসায়নের প্রথম আচার্য। তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার করেন। বাঙালিকে রসায়নের প্রয়োগগত ক্ষেত্রেও নিপুন করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস। তার আত্মজীবনীর নাম লাইফ এন্ড এক্সপেরিয়েন্স অফ এ বেঙ্গলি কেমিস্ট।

মেঘনাদ সাহা:

মেঘনাদ সাহা বিখ্যাত হয়ে আছেন তার উল্লেখযোগ্য গবেষণা থিওরি অফ থার্মাল আয়নাইজেশন এর জন্য। তার স্মরণীয় কীর্তি ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স বর্তমানে পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও তিনি দামোদর উপত্যকা সংস্কার, বন্যা প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা প্রকৃতি বিচিত্র বিষয়ে তার বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু:

সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি বিজ্ঞানী। তিনি প্লাঙ্ক সূত্র ও কোয়ান্টাম সংখ্যাতত্ত্বের জনক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আবার একই সঙ্গে তিনি একজন সাহিত্যিক ছিলেন।

দেবেন্দ্রমোহন বসু:

জগদীশচন্দ্র বসুর স্নেহধন্য এই পদার্থবিজ্ঞানী চৌম্বক ক্ষেত্রের উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করার জন্য চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়:

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অন্যতম ছাত্র জ্ঞানেন্দ্রনাথের গবেষণার বিষয় ছিল কোলয়েডের মধ্যে তড়িৎ উদ্ভবের ক্রিয়া।

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়:

বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একজন খ্যাতনামা গণিতবিদ ছিলেন।

শিশির কুমার মিত্র:

বিশিষ্ট বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী শিশির কুমার মিত্রের গবেষণার বিষয় ছিল রেডিও ফিজিক্স। তিনি ম্যাডাম কুরির গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগের অধিকারী। তার গ্রন্থটির নাম দি আপার এটমোসফিয়ার।

প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশ:

বিশ্ব আধুনিক ভারতীয় রাশিবিজ্ঞানের জনক প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল
ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছিলেন।

উপেন্দ্র ব্রহ্মচারী:

কালাজ্বরের প্রতিষেধক ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার করে বিখ্যাত হয়ে আছেন বাঙালির হৃদয়ে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাঙালি:

চিকিৎসা শাস্ত্রেও বাঙালি বিজ্ঞানীদের অবদান কম নয় স্বনামধন্য কয়েকজন বাঙ্গালী চিকিৎসা বিজ্ঞানী হলেন নীলরতন সরকার। তার উল্লেখযোগ্য গবেষণা হলো সিরোসিস অফ লিভার ইন চিল্ড্রেন। এ ছাড়াও রয়েছেন মহেন্দ্রলাল সরকার, বিধানচন্দ্র রায়, রাধাগোবিন্দ কর চুনীলাল বসু, গিরীন্দ্রশেখর বসু প্রমুখো।

প্রযুক্তি ও কারিগরি বিজ্ঞানে বাঙালি:

গোলাক চন্দ্র নন্দীই ছিলেন ভারতের প্রথম ইঞ্জিনিয়ার। তিনি দেশে প্রথম বাষ্পীয় ইঞ্জিন নির্মাণ করেন। শিবচন্দ্র নন্দী ভারতের প্রথম ইলেকট্রিক্যাল এবং টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার। এছাড়াও ছিলেন সীতানাথ ঘোষ, রাজকৃষ্ণ কর্মকার, কালিদাস শীল, নীলমণি মিত্র, হেমেন্দ্রমোহন বসু, বিপিন বিহারী দাস, প্রমথনাথ বসু প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমূখ।

উপসংহার:

বাঙালি বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রতিভাবানদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। বিজ্ঞান চর্চায় তাদের উৎসাহ আছে। কিন্তু দেশে গবেষণার সুযোগ সুবিধার অভাবে। অনেকেই বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। মেধার এই অপচয় সমগ্র জাতির পক্ষেই ক্ষতিকর। আমাদের দেশের রাষ্ট্রনায়কদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরী। পরিকল্পিতভাবে গবেষণার সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে ছাত্রদের মেধা পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। তবেই আগামী প্রজন্ম আরো অনেক কিছু উপহার দিতে পারবে বিজ্ঞানের মাধ্যমে।

———–০————

আরো দেখো: একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

CLOSE

You cannot copy content of this page